ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও হোয়াইট হাউসে ফেরার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি ঐতিহাসিক নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচনের আগে বহু প্রতিশ্রুতি ও পরিবর্তনের অঙ্গীকার করে যে নতুন প্রত্যাশার পাহাড় তৈরি করে রেখেছেন, তারফলে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্পের সামনে এখন অনেক কাজ। আর এই কাজে তিনি তার প্রশাসনে নতুন ও পুরাতন কাদেরকে রাখতে যাচ্ছেন বা ট্রাম্পের এবারের প্রশাসনে কোন নীতিগত পরিবর্তন আনতে চলেছেন এবং তার নতুন মন্ত্রিসভায়/প্রশাসনে কারা আসতে চলেছেন, আর তা নিয়ে ইতোমধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে।
মার্কিন বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার মাধ্যমে তিনি তার প্রশাসনে নতুন মুখ ও পুরনো মিত্রদের অন্তর্ভুক্ত করতে চলেছেন। ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভায় দেখা যেতে পারে রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র ও ইলন মাস্কের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে আর অন্যদিকে মাইক পেন্স ও ক্রিস ক্রিস্টির মতো সমালোচকরা বাদ পড়তে পারেন বলে আলোচিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, যা তার রাজনৈতিক জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এবার তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরছেন এমন একটি সময়ে, যখন দেশ বিভক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। ট্রাম্পের লক্ষ্য হবে তার প্রশাসনে এমন কিছু পরিচিত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বকে অন্তর্ভুক্ত করা, যারা তার প্রথম প্রশাসনে ছিলেন বা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
নতুন যুক্ত হতে পারেন যারা
পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার যাত্রায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশে যাদেরকে বেশি মাত্রায় দেখা গেছে, এবারের প্রশাসনে তাদের স্থান হতে পারে। এই তালিকায় যারা আছেন-
রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র: যুক্তরাষ্ট্রের বহুল পরিচিত ডেমোক্র্যাটিক পরিবারের একজন সদস্য তিনি। প্রথমে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও পরে নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের সাথে থেকে তাকে সমর্থন দিয়ে প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার এই অবস্থানের জন্য মার্কিন প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তাকে দেখা যেতে পারে। ভ্যাকসিন-বিরোধী অবস্থানের জন্য বেশ পরিচিত কেনেডি। এবার স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি উচ্চপদে আসতে পারেন তিনি। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে কেনেডিকে নিয়ে ‘স্বাস্থ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ’ এর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ইলন মাস্ক: প্রখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেসলার মালিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এর মালিক মাস্ক এবারের মার্কিন নির্বাচনে বেশ আলোচিত চরিত্র ছিলেন। ট্রাম্পের পাশে যখন অনেকেই ছিল না, তখন মাস্ক তার অর্থ ও সময় দিয়েছেন ট্রাম্পের প্রচারণায়। ট্রাম্প তাকে সরকারি কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও দক্ষতার জন্য একটি কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন বলে আলোচিত হচ্ছে। টেক জায়ান্টদের সাথে ট্রাম্পের নানামুখি অবস্থান থাকলেও ইলনের সাথে রয়েছে আলাদা ক্যামেষ্ট্রি।
বিবেক রামাস্বামী: আমেরিকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটকে ট্রাম্পের দিকে আনতে অনেক বড় ভূমিকা ছিল রামাস্বামীর। যেমন পেনসিলভেনিয়া প্রদেশে ট্রাম্পের জয়ে নেপথ্যে এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। সেই প্রদেশে প্রায় ৬ লাখ এশিয়ান ভোটার ছিলেন। একটাসময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রাইমারিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ছেড়ে ট্রাম্পের হয়ে প্রচারণায় মুখর ছিলেন। কমলা হ্যারিসের দিক থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের ভোট ট্রাম্পের দিকে টেনে আনাতে তার অবদানের জন্য বড় কোনো প্রতিদান পেতে পারেন নতুন ট্রাম্প প্রশাসনে। হয়ে উঠতে পারেন এশিয়ান ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্টিফেন মিলার: যিনি আগেও ট্রাম্পের উপদেষ্টা ছিলেন এবং ছিলেন ট্রাম্প সরকারের অভিবাসন নীতির অন্যতম কারিগর। পুনরায় ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির নেতৃত্বে থাকতে পারেন মিলার। ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনে ‘অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ক প্রচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো, বড় আকারে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ও কিছু দেশ থেকে প্রবেশ নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। এইসব নীতি বাস্তবায়নে স্টিফেন মিলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
মাইকেল ফ্লিন: ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন, এবারও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন তিনি। ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে ফ্লিনের কঠোর অবস্থান বেশ আলোচিত এবং তিনি এই দায়িত্বে আবারও সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন বলে ধারণা।
পুরাতন যারা বাদ পড়তে পারেন
জারেড কুশনার ও ইভাঙ্কা ট্রাম্প: ট্রাম্পের প্রথমবারে প্রশাসনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন তার কন্যা ও জামাতা। রাজনীতিতে না ঢুকে এবার পারিবারিক জীবনকে তারা অগ্রাধিকার দিতে চাইছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তারা এবার নির্বাচনী প্রচারণায় তেমন একটা অংশও নেননি।
নিকি হ্যালি: তিনি ছিলেন ট্রাম্পের প্রথম টার্মে জাতিসংঘের দূত, তবে বিভিন্নসময় ট্রাম্পের সমালোচনা করে হয়েছেন আলোচিত। আর এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় তাকে দেখা যায়নি।
মাইক পেন্স: যিনি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ২০২০ সালের নির্বাচনের পর তার সাথে মতবিরোধে জড়িয়েছিলেন, এবার নির্বাচনী প্রচারণায় তার সমর্থন দেননি।
ক্রিস ক্রিস্টি: প্রাক্তন নিউ জার্সি গভর্নর, যিনি ট্রাম্পের প্রথম প্রচারণায় সহায়তা করেছিলেন কিন্তু পরে তার কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন, তিনিও এবার বাদ পড়তে যাচ্ছেন বলাই যায়।
জন কেলি ও মার্ক মিলি: ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সামরিক উপদেষ্টা জন কেলি ও মার্ক মিলি। কিন্তু পরবর্তীতে পট পরিবর্তনের ধারায় ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাদের। কাজেই ধরে নেয়াটা স্বাভাবিক এবারের নতুন প্রশাসনে স্থান হচ্ছে না তাদের।
ট্রাম্পের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধাবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের ঘোষণা আসার আগেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে আলোচনা তৈরি করেছেন এবং মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেবার আশ্বাস দেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে রুশ-মার্কিন সম্পর্কে (ইতিবাচক) পরিবর্তন ঘটবে বলে অনেক রাশিয়ান রাজনীতিক আশাবাদ রেখেছেন অনেক আগে থেকেই। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেও কিছুটা উদ্বেগও জানিয়েছেন। ফিলিস্তিন, সৌদি আরব ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশের প্রধানগণ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ট্রাম্পকে। তাইওয়ান ও করোনার ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক কেমন হয়, তা অনেকের কৌতুহল। বাইডেনের আমলে মানবাধিকার প্রশ্নে ভারত নানাসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, ট্রাম্পের জয়ের পরে নরেন্দ্র মোদির অভিনন্দন বার্তায় দেখা গেছে অন্যরকম উচ্ছাস। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষেও নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এখন দেখার বিষয়, গাজা-ইসরাইল ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পাশাপাশি বৈশ্বিক এসব বিষয় কীভাবে সামলান ট্রাম্প।
অভিবাসন নীতি ও অর্থনৈতিক কৌশল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১৩ মিলিয়নেরও বেশি অভিবাসীকে নির্বাসিত করার যে পরিকল্পনার কথা বলে এসেছেন ট্রাম্প, দেখার বিষয় তা কীভাবে বাস্তবায়ন করেন তিনি। অভিবাসন নীতিতে ট্রাম্পের এই দীর্ঘদিনের কঠোর অবস্থান তাকে জনপ্রিয় করেছিল মার্কিন ভোটারদের কাছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না বলে বহুমত রয়েছে। এছাড়া এই কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হতে পারে যা মার্কিন পরিবর্তিত পরিস্থিতি কতোটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে। এছাড়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্প দেশীয় পণ্যের সুরক্ষা এবং বিদেশি পণ্যের ওপর উচ্চ কর আরোপের কথা বলে এসেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের ওপরে চাপ বাড়াবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
গণতন্ত্র-মানবাধিকার ইস্যু ও সমালোচনা: কমলা হ্যারিস নির্বাচনী প্রচারণায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি এবং অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর অবস্থান ভোটারদের মধ্যে বেশি প্রভাব ফেলেছে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ট্রাম্পপন্থীদের দূরত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। এরকম নানা ইস্যুতে গণতন্ত্র-মানবাধিকার সমর্থনকারী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। এই অবস্থান থেকে ট্রাম্প ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।
ফেডারেল মামলা ও আইনি অবস্থা: মার্কিন বিচার বিভাগ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে থাকা ফৌজদারি মামলাগুলি শেষ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও গোপন নথি সংক্রান্ত মামলাগুলি সমাধান হওয়ার পথে। এমনকি, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আশা করছেন যে, তার প্রশাসন বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করতে পারে এবং আইনগত বাধাগুলিকে কম গুরুত্ব দেবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে বিশ্বের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত কারণে প্রেসিডেন্ট বা দলীয় ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে খুব বড় একটা পরিবর্তন না হলেও বিভিন্ন ছোটবড় বিষয়ে গুরুত্ব নয়তো উদাসীনতা বেড়ে যায়। যা অনেকসময় বিশ্বে স্থিতিশীলতা আনে নয়তো অশান্তি তৈরি করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন যাত্রায় ইতিবাচক ধারা নিয়ে আসবেন, এ শুভ কামনা!
(বিভিন্ন মার্কিন গণমাধ্যমের খবর-বিশ্লেষণ থেকে অনূদিত এবং সম্পাদিত)