Image description

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ ১০টি সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার- টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’। সোমবার (৭ অক্টোবর) রাত ৮টায় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের শাহাদাত বার্ষিকী এবং নির্যাতন বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে ওয়েবিনার ও অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এমন সুপারিশ করেন সংগঠনটির সভাপতি ড. শিব্বির আহমেদ। 

অন্যান্য সুপারিশ সমূহ হলো- সরকারি কমিশন গঠন করে তদন্ত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি নিশ্চিত করা, ভিক্টিম সাপোর্ট সেল গঠন, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট বিধান প্রণয়ন করা, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বলয়, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির জন্য বিধিমালা তৈরি করা, ছাত্ররাজনীতির সংস্কার ও বয়সসীমা নির্ধারণ করা, হলগুলোকে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করা, ‘ইনক্লুসিভ ক্যাম্পাস’ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, আবাসন সংকটের সমাধান করা এবং ৭ অক্টোবর ক্যাম্পাস নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করা। 

গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় শিব্বির আহমেদ জানান, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ই আগস্টকে কেন্দ্র করে অতি রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে আগস্ট মাসে নির্যাতনের ঘটনা বেশি হয়ে থাকতে পারে। নির্যাতিতদের মধ্যে ৮০% সাধারণ ছাত্র যাদেরকে শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে, ১৪% ছাত্রশিবিরের কর্মী, ২% ছাত্রদল, ২% বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরের সাধারণ জনতা, এবং এছাড়া ২% ছাত্রলীগ কর্মী দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন। 

প্রতিবেদনটি ২০১০-২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নির্যাতিত ৫০ জন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

এসময় ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ উদ্দিন নকীব, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চোধুরী, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সভাপতি অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস এর প্রধান উপদেষ্টা নূর খান লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শেহরিন আমিন ভুঁইয়া, মানবাধিকার আইনজীবী ও সোচ্চারের লিগ্যাল ডিরেক্টর ব্যারিস্টার শাইখ মাহদি এবং বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ৮৪ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে, ১০% ক্ষেত্রে নির্যাতন শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসের কোনো স্থানে এবং শেষ হয়েছে আবাসিক হলের নির্দিষ্ট নির্যাতনের কক্ষে। ৬% ক্ষেত্রে নির্যাতন শুরু এবং শেষ হয়েছে ক্যাম্পাসেই।  সাক্ষাৎকার দেয়া নির্যাতিত ৫০ জনের মধ্যে ২৬% শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১৮% শিক্ষার্থী খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) এবং ১৬% শিক্ষার্থী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

গবেষণায় নির্যাতনের ২২টি কারণের কথা বলেছে সংগঠনটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে ব্যর্থতা, রাতের গেস্টরুমের বাধ্যতামূলক মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকা, সিনিয়র নেতাদের যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়া, ইসলামিক পেজ বা বিরোধী দল বা মতের পেজে লাইক দেওয়া, ফেসবুকে ইসলামিক পোস্ট দেওয়া বা ওয়াজ শেয়ার করা, প্রধানমন্ত্রী, তার পিতা, পরিবার বা ভারত বিরোধী পোস্ট দেওয়ার কারণে, সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করা, হিজাব ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা নিয়ে সমালোচনা করা, ব্যক্তিগত বিরোধ ইত্যাদি।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ উদ্দিন নকীব বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিবান, যোগ্য লোককে আনা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডিতে যারা ছিল তাদের কাজই ছিল ক্ষমতাসীন ছাত্র রাজনীতির নেতাদের অপকর্মকে আড়াল করা।”

তিনি বলেন, আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হরহামেশাই সংঘর্ষ হতো। তবে সেগুলো প্রধানত ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ। কিন্তু সেইসব সংঘর্ষ ও গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার চরিত্রে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ছাত্র সংঘর্ষ অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সেখানে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার অভাব, শাসক দলের প্রভুত্ব করার খায়েশের মতো ব্যাপারগুলো রয়েছে। অন্যদিকে গত পনেরো বছরে যা ঘটেছে তাকে অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। টার্গেট করে ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ডেকে এনে বা ধরে এনে বিশেষ কক্ষে রাতভরে নির্যাতন, এমনকি মেরে ফেলা; এই ধরনের জঘন্য কাজগুলো পরিলক্ষিত হয়েছে এই সময়ে। এর যথাযথ বিচার হওয়া জরুরি।

তিনি আরো বলেন, গত পনেরো বছরে সরকার, ছাত্রসংগঠন, রাষ্ট্রব্যবস্থা একাকার হয়ে এই ধরনের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিল। বিচারহীনতা ও যেকোনো কিছু করে পার পেয়ে যাবে এটা নিশ্চিত থাকায়ই এ ধরনের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই এসব ঘটনায় চুপ থেকেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অভিভাবকও এসব ঘটনায় চূড়ান্ত খারাপ ঘটনা না ঘটার আগ পর্যন্ত কোনো ধরনের কথা বলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে মেধার বদলে দলীয়করণ বেশি করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।